সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা: ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও গৌরবের শতবর্ষী মহাকাব্য – আবরার জাওয়াদ আফিফ

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ একটি গৌরবোজ্জ্বল নাম। ১৮৯৮ সালে শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ীর উদ্যোগে কলেজটির যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে এটি ‘পাবনা ইনস্টিটিউশন স্কুলে’ এম.এ মানের পাঠদান চালু করে এবং একই বছরের ডিসেম্বরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি লাভ করে। তখন ছাত্রসংখ্যা ছিল মাত্র ২৯ জন। পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে নাম হয় ‘পাবনা কলেজ’ এবং ১৯১১ সালে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্মৃতিরক্ষার্থে বর্তমান নাম “এডওয়ার্ড কলেজ” প্রদান করা হয়।

 

প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ গোপাল চন্দ্র লাহিড়ীর পর ১৯১৪ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন রায় রাধিকা নাখ বোস, যিনি দীর্ঘ ৩৪ বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়ে ইংরেজি, ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, বিজ্ঞান, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি পড়ানো হতো। কলেজের উন্নয়নে সে সময় তাড়াশের জমিদার রায় বাহাদুর বনমালী রায়, কাশিমবাজারের মহারাজা স্যার মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী, শরীফুন্নেছা চৌধুরানী, ক্ষিরোদ গোবিন্দ চৌধুরী, প্রমদা গোবিন্দ চৌধুরীসহ বহু জমিদার ও দানশীল ব্যক্তি অর্থ ও জমি প্রদান করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো রাধানগর মৌজার প্রায় ১৬ একর জমি দান, যার ওপর কলেজের বর্তমান ক্যাম্পাস গড়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালের ১ মার্চ থেকে কলেজটি সরকারিকরণ হয়। বর্তমানে কলেজের জমির পরিমাণ ৪৩ একর। বর্তমানে এখানে ১৯টি বিষয়ে অনার্স, ১৭টি বিষয়ে মাস্টার্স, বিএ (পাস কোর্স), বিএসএস, বিএসসি ও এইচএসসি চালু আছে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬ হাজার ৬৪৬। শিক্ষক আছেন ১৪৫ জন।

 

উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ ধীরে ধীরে ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে রূপ নেয়। এখানে যেমন বামপন্থি প্রগতিশীল রাজনীতির বিকাশ ঘটেছিল, তেমনি রক্ষণশীল শক্তিরও দৃঢ় অবস্থান দিল। স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের শিক্ষার্থীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

 

 

এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক ছাত্র, সাহিত্যিক গোলাম সাকলায়েনের ‘অন্তরঙ্গ আলোকে ডক্টর শহীদুল্লাহ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ১৯৫১ সালে কলেজের বার্ষিক মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে এসে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ভাষা আন্দোলনের সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও একাধিকবার এডওয়ার্ড কলেজে ছাত্রসমাবেশে বক্তৃতা করেন। ১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রসভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ১৯৫৭ সালে এডওয়ার্ড কলেজে স্থাপিত হয় পাবনার প্রথম শহীদ মিনার। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানেও পাবনায় নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেছে এই কলেজের শিক্ষার্থীরা।

 

 

বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, বামপন্থী নেতা চারু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, পদার্থবিজ্ঞানী অরুণ কুমার বসাক, একুশে পদকপ্রান্ত প্রখ্যাত সাংবাদিক রণেশ মৈত্র, কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কবি ওমর আলী, রাজনীতিবিদ সেলিনা বানু, গায়ক কামাল আহমেদ, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত লেখক রশিদ হায়দায়, পাবনা জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল মমিন ভালুকদার, ভাষা সৈনিক মোতাহার হোসেন তালুকদার, অর্থনীতিবিদ ফাইজুল ইসলাম, লেখক সরদার জয়েনুদ্দিন, শিক্ষাবিদ খন্দকার আবুল কাসেম, কূটনীতিবিদ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম. সাইদুর রহমান খান, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মাদ লুৎফর রহমান, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) সাবেক উপাচার্য ড. এম আনোয়ার হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবু সাইদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, পাবনায় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী রফিকুল ইসলাম বকুল এই কলেজের সাবেক ছাত্র।

 

 

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ বরাবরই অনন্য সাফল্য প্রদর্শন করে আসছে। ২০২৩ সালে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিভাগ থেকেই ৩০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ জন সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ লাভ করে। ২০১৮ সালে এই কলেজের শিক্ষার্থী রাকিন নাওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ২০২০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম হন মিশরী মুনমুন। ২০২৩ সালে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন সুদীপ্ত পোদ্দার এবং একই বছরে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন আশরাফুল আলম সাগর। দীর্ঘ এক যুগ উচ্চমাধ্যমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালে পুনরায় চালু হয়, আর ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এডওয়ার্ড কলেজ থেকে মোট ১১৬ জন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

 

 

শিক্ষার উৎকর্ষতা, ঐতিহাসিক অবদান এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের ধারায় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা আজও উত্তরাঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে আলোকিত। একদিকে এই কলেজ থেকে গড়ে উঠেছে নেতা, বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, সাংবাদিক, আমলা, শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা-অনাদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রতিভা ও মেধা দিয়ে দেশের শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে।

 

 

শতবর্ষ পেরিয়েও এডওয়ার্ড কলেজ তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করার অঙ্গীকারে। এই প্রতিষ্ঠান কেবল একটি কলেজ নয়; এটি দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতীক। ভবিষ্যতেও সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ জ্ঞানচর্চা, দেশপ্রেম ও গণতান্ত্রিক চেতনার আলোয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে পথ দেখাবে।

 

 

আবরার জাওয়াদ (আফিফ)

নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পাবনা স্টাডিজ (সিপিএস)